বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এটি একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের নিদর্শন। আমাদের পূর্বপ্রজন্ম রক্তের বিনিময়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, নিঃশেষে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েও ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকা যায়। এ কারণেই ১৯৭১ সালকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে, ১৯৭১ সাল ছিল দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের একটি অধ্যায় মাত্র। এ দেশের ইতিহাস ১৯৭১ সালে শুরু হয়নি, শেষও হয়নি। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন ও পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ—উভয়ই ছিল সময় ও ইতিহাসের দাবি। অনেক রাজনৈতিক নেতা একে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবেই দেখেছেন। তারা ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালকে একটি ধারাবাহিক মুক্তির অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ১৯৪৭ সালের বিভাজন ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব হতো কি না, তা নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে।
একাত্তর একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও অভিমুখ বাস্তবায়নের জন্য ঘটেছিল। বৈষম্যহীন সমাজ, রাষ্ট্রীয় জুলুমের অবসান, এবং ভাষা ও ধর্মের নামে নিপীড়ন থেকে মুক্তি ছিল এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭২ সাল থেকেই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে শুরু করে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি, এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন ছিল সেই সময়ের সাধারণ চিত্র। এ ব্যর্থতার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল পুরো জনগোষ্ঠীকে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রথম দুই দশকে রাষ্ট্রগঠন প্রধান লক্ষ্য না হয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, সামরিক শাসন, গণতন্ত্রহীনতা এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড প্রধান হয়ে ওঠে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র ফিরে এলেও রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক কাঠামো বহাল থাকে। পঞ্চবার্ষিক ভোটাভুটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট ছিল না। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে, যা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়।
এর পরিণতিতে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোর মধ্যে গণরায় প্রতিফলিত হয়নি। এসব নির্বাচন গণতন্ত্রের চেতনার পরিপন্থী ছিল। ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগের শাসনামল গুম, খুন, নিবর্তনমূলক আইন, এবং মেগা দুর্নীতির মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার নজির সৃষ্টি করে। অনেক গবেষক এ শাসনামলকে ‘বাকশাল ২’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান এ পটভূমিতে ঘটেছিল। তরুণ প্রজন্ম বৈষম্যমূলক কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এই আন্দোলন ছিল বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তরুণদের বিদ্রোহ। আন্দোলনের ব্যানার ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ দ্রুত বৃহত্তর জনগণের সমর্থন পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম এক দফা দাবি ঘোষণা করেন: ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রস্তাব।
একাত্তরের চেতনাকে সুসংহত করার প্রয়াসে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। অতীতে ছাত্র-জনতার আত্মদান ক্ষমতাসীন দলগুলোর বেইমানিতে অপব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এবার তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের ডাক দিয়েছে। এ প্রয়াস বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলন একাত্তরের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার অঙ্গীকার বহন করছে। এই আন্দোলন থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার দায় বর্তেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে এই তরুণ প্রজন্মের সফলতার ওপর।