রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ভূমিকা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস (Rajshahi University) বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই রাজশাহী শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, যা উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গঠিত হয়।
ব্রিটিশ যুগে রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ৷
সে সময়ে রাজশাহী কলেজে আইন বিভাগসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট শ্রেণী চালু করা হয়৷ কিন্ত এর কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায় এসব কার্যক্রম৷
সে সময়েই রাজশাহীতে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়৷ ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার দেশের সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে৷
রাজশাহীতে এ সময় স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়৷
ভাষা আন্দোলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
- ভাষা আন্দোলনের কিছুদিন আগ থেকেই মূলত রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়৷
- ১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়৷
- রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য সর্বপ্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরের ভুবন মোহন পার্কে ৷
- প্রথম অবশ্য দাবি ওঠে রাজশাহী কলেজেই৷ ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গনে সমবেত হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাস করার দাবি তোলে৷
- পরবর্তীতে ১৩ই ফেব্রুয়ারি ভূবন মোহন পার্কেই আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ এমএলএ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় আরও একটি জনসভা৷
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন ইদ্রিস আহমেদ এমএলএ, প্রভাষ চন্দ্র লাহিড়ী, খোরশেদ আলম, আনসার আলী, আব্দুল জব্বার প্রমূখ৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ক্রমেই তীব্র হতে থাকে৷
- এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন ১৫ ছাত্রনেতা ৷
- পরে ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে ঢাকায় একটি ডেলিগেশন পাঠানো হয়৷ ওই ডেলিগেশনের সদস্যদের মধ্যে মরহুম আবুল কালাম চৌধুরী ও আব্দুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য৷
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এভাবে একের পর এক আন্দালনের চাপে স্থানীয় আইন পরিষদ রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়৷
- এই আন্দোলনে একাত্ব হন পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী মাদার বখশ৷
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মাদার বখশ
- ১৯৫৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভুবন মোহন পার্কে আরও একটি জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাদার বখশ সরকারকে হুশিয়ার করে বলেন, যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না হয় তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব৷
- মাদার বখশের এই বক্তব্যে সাড়া পড়ে দেশের সুধী মহলে এবং সাথে সাথে টনক নড়ে সরকারেরও৷
- অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাশ হয়।
- নতুন উপাচার্য প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরীকে সঙ্গে নিয়ে মাদারবখশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পরিকল্পনা প্রণয়ন করে৷
- এ দুজনকে যুগ্ম সম্পাদক করে মোট ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়৷
- এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার এম এ খুরশীদ৷
- একই বছর ৬ জুলাই প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে।
- শুরুতে ১৬১ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
- প্রথম ক্লাস শুরু হয় রাজশাহী কলেজে৷ উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের দফতর প্রতিষ্ঠা করা হয় পদ্মার তীরের বড়কুঠি নামে পরিচিত ঐতিহাসিক রেশম কুঠি বা নীল কুঠির উপর তলায়৷
- বড়কুঠির কাছেই তৎকালীন ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমিতে চিকিৎসাকেন্দ্র ও পাঠাগার তেরি করা হয়৷
- বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতর স্থাপন করা হয় জমিদার কুঞ্জমোহন মৈত্রের বাড়িতে৷
- বড়কুঠি পাড়ার মাতৃধামে স্থাপন করা হয় কলেজ পরিদর্শক দফতর৷
- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন ওসমান গনি ও প্রথম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিযুক্ত হন অধ্যাপক আব্দুল করিম৷
- শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাড়া করা বাড়িতে গড়ে ওঠে ছাত্রাবাস৷
- রাজশাহী কলেজ সংলগ্ন ফুলার হোস্টেলকে রুপান্তরিত করা হয়৷
- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস হিসেবে বড়কুঠি এলাকার লালকুঠি ভবন ও আরেকটি ভাড়া করা ভবনে ছাত্রী নিবাস স্থাপন করা হয়৷
- ১৯৫৮ সালে বর্তমান ক্যাম্পাসে দালান-কোঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয়।
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয় মতিহারের নিজস্ব ক্যাম্পাসে এবং ১৯৬৪ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অফিস ও বিভাগ এখানে স্থানান্তরিত হয়৷
- এই ক্যাম্পাসটি গড়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ানি টমাসের স্থাপত্য পরিকল্পনায়৷
প্রতিষ্ঠার পটভূমি:
- ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর পূর্ব বাংলায় উচ্চশিক্ষার চাহিদা বাড়তে থাকে।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর শিক্ষার্থীর চাপ কমানোর জন্য এবং উত্তরাঞ্চলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
- এই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৩ সালে “রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন” পাশ হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রথম দিকের বছরগুলো
- শুরুর দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেবল কয়েকটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। প্রথম ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ।
- শুরুতে প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং পাঠদান নগর ভবনে পরিচালিত হতো। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়, যা প্রায় ৭৫২ একর জমির উপর বিস্তৃত।
বিস্তৃতি ও উন্নয়ন
- বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি অনুষদের অধীনে প্রায় ৫৯টি বিভাগ রয়েছে।
- বিজ্ঞান, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, আইন, প্রকৌশলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা প্রদান করে থাকে।
ঐতিহাসিক ভূমিকা
- ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন।
- বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ “শহীদ স্মারক” এই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণায় একটি অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে শিক্ষার্থীরা উচ্চমানের শিক্ষার সুযোগ পায় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখতে সক্ষম হয়।